শুভ্রা সাহা, 2020-10-05
প্রতিবছরের মতো এবারেও মর্ত্য থেকে মানে বাপেরবাড়ি থেকে ইনভাইট করা হয়েছে দুর্গা উইথ ফ্যামিলিকে। নেমতন্নটা ফুলফ্যামেলির হলেও বাড়ির কর্তা ভোলে মহেশ্বর বরাবর বাড়ি পাহরার দায়িত্ব নিজের মাথায় নেন।দুর্গাকেই বাচ্চাকাচ্চা দিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠান।
এটাতে দুটো লাভ হয় একদিকে উমা ডারলিং এর কাছে বেশ কেয়ারিং হাজব্যান্ড শো করা হয়। আবার ক’দিন ফাঁকা বাড়িতে হাত পা ছড়িয়ে নিজের মনের মতো করে গাঁজায় দম দেওয়া যায়। এতকাল উমাকে ধমকে টমকে চুপ করিয়ে দিতে পারতেন ভোলেমহেশ্বর গাঁজা বিষয়ে। কিন্তু যবে থেকে এই গনু , কাতু ,লখু ,সরুরা বড় হয়েছে তবে থেকে সারাক্ষন ওৎ পেতে বসে থাকে। গাঁজার কল্কেতে ধোঁয়া দিতেই দুই মেয়ে এক্কাটা হয়ে ” ড্যাড , শোন এবার তোমাকে একটু আপটুডেট করতে হবে নিজেকে।এতকাল যা করেছো করেছো — এখন আর সেগুলো চলবে না।” ব্যাস এবার দুছেলেও তার সাথে পো ধরে বলে “একদম ঠিক, ড্যাড তোমাকেও ভাবতে হবে আমাদের সোস্যাল প্রেসটিজটার কথা। আফটার অল আমাদের মতো সেলিব্রেটি ফ্যামেলিতে তোমার হ্যাবিটসগুলো না জাষ্ট যায় না।” ছেলেমেয়েদের বাক্যবানে জর্জরিত ভোলে মহেশ্বর পুরোনো জটওয়ালা মাথা চুলকে বলেন ” হেঁ ,হেঁ তা আর কি করি বলো —“
আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু সমস্বরে ছেলেমেয়েরা চেপে ধরে বলে “কি আবার করবে — নিজেকে যুগের সাথে মিলিয়ে একটু স্মার্ট করে তোল ” কাঁদো কাঁদো হয়ে ভোলানাথ বলেন “সেকি ? আমি ভোল পাল্টে ফেললে তো মর্ত্যবাসী আমাকে চিনতেই পারবে না।” এবার সরু হাজার হলেও বিদ্যেবতী, বুঝিয়ে বলে ” ড্যাড তোমার ভোল কেন পাল্টাবে জাষ্ট একটু স্যাণ্ডার্ড হবে। আচ্ছা তোমাকে আরো সহজ করে বলছি যেমন তুমি তো ঐ টাইগারপ্রিন্টের ওয়ানপিস ছাড়া পড়তে পারো না — রাইট। তুমি কোন ব্র্যান্ডেড কোম্পানীর শো রুম থেকে অনলাইন আনিয়ে নাও। হেয়ার স্টাইলটাও এমনি থাক তবে নামী কোন পার্লারের লোকদের বলো তারা যেন সেটাকে প্রতিমাসে এসে যেন সেট করে দিয়ে যায়।”
এইসমস্ত কথা শুনতে শুনতে ভোলেমহেশ্বরের কানের পোকা বের হবার জোগাড়। ফাঁকাবাড়িতে বছরের এ’কটাদিন নন্দী আর ভিঙ্গিকে নিয়ে নিজের মতো করে দিন কাটাবার জন্য সারাবছর উদগ্রীব হয়ে থাকেন। এবছরও তাইই ছিলেন। শ্বশুরবাড়ি থেকে ডাকও এসেছে।তবে এদের যাওয়ার ইচ্ছেটা যেনো কেমন হালকা গোছের। অন্যসময় মাসদুয়েক আগে থেকেই মামাবাড়ি যাবার আনন্দে লখু , সরু তো পার্লার না পিলার কোথায় গিয়ে হত্ত্যে দিয়ে বসে থাকে।
একবার ওদের জিজ্ঞেস করেছিলেন মেয়েরা হাসতে হাসতে বলেছিল ওরা সেখানে গিয়ে নিজেদের রূপ ঝালিয়ে নেয়। এবার সেখানে যাবার নামটি পর্যন্ত করছে না ওরা। সেই ঝালাইয়ের দোকান নাকি বন্ধ।তাই দুবোন ঘরেই সারাক্ষন মুখে এটা সেটা ঘষেই চলছে। ওদিকে উমা তো বাপেরবাড়ীর শপিং করে করে ক্লান্ত হয়ে যায় প্রতিবছর। এবারো নাকি করেছে তবে অনলাইন।ছোট ছোট প্যাকেটে করে কিসব আসছে।
একদিন খুব কৌতুহল হওয়াতে একটা প্যাকেট খুলেছিলেন বটে ভোলেমহেশ্বর ।তবে বুঝতে পারে নি। উমা টিপ্পনি কেটে বলেছিল ” বুঝলে না তো এগুলো কি ? উফ্ বাবা এই বুড়োকে নিয়ে যে আমি কি করি। কোন খবরই রাখে না।সারাক্ষন ভাঙ , গাঁজা নিয়ে ব্যাস্ত। এগুলোকে মাস্ক বলে।আর এটা স্যানিটাইজার।মর্ত্যবাসী এখন এগুলো ছাড়া এক পাও চলতে পারছে না। তাই ভাবলাম এবার হরেক ডিজাইনের মাস্ক বানিয়ে নিয়ে যাব। বিশু মানে চামচিকার বাবা বিশ্বকর্মা ওর ফ্যাক্টরীতেই অর্ডার করেছিলাম।”
তখন মহেশ্বরের মনে পড়েএবার তার মাথায় জল ঢালতে আসবার সময়ও তো সবার মুখে এগুলো বাঁধা ছিল।আর তার মাথায় দুধজল দেবার আগে সুগন্ধি একটা তরল পদার্থকে হাতে মেখে আবার কিছুটা তার মাথায় মাখিয়ে তারপরেই তো জল ঢেলেছিল। “তা ফ্যাশন এখনো চলছে বুঝি—” ” তা এখন বলতে পারো।তবে সেটাকে নিয়েই তো সকলে নাজেহাল।তাই আমাকে এবার বলেছে অসুর আমরা সামলে নেব তুমি ঐ পাজি বদজ্জাৎটাকে শায়েস্তা করো। তার ক্ষমতাও কোন অংশে কম নয়।এই কয়েকমাসে তো একেবারে নিজে নেচে মর্ত্যবাসীকে নাচিয়ে বেড়াচ্ছে। ভেবেছিলাম এবার ভার্চুয়্যাল পূজোই নেব।” হাঁ করে ঢোক গিলে ভোলে মহেশ্বর বলেন ” ভার্চুয়্যাল পূজো — সেটা আবার কি ? ” “এটা হলো গিয়ে আমাকে এতটা পথ ঠ্যাঙিয়ে মর্ত্যে যেতে হতো না। আমি স্বর্গে বসেই ঝুম সিটিংবক্সে হাজির হতেম আর ওরাও মর্ত্যে থেকে একইভাবে সেই সিটিং বক্সে জয়েন করতো।ব্যাস ” ভোলে মহেশ্বরের সারাবছরের এ’কটা দিন স্বতন্ত্র থাকবার বাসনায় পুরো জল ঢেলে দেয় এই ভার্চুয়্যাল পূজো। “তবে কি জানো তো মর্ত্যের কিছু মানুষ প্রশ্ন তুলেছে আমি নাকি ঐ বিচ্ছু নাচুনিটাকে বধ করতে পারবো না। তাই তো পুরো সাবধনতা মেনেই যেতেই হবে।”
ভোলে মহেশ্বর তৎপর হয়ে বলেন ” তা তো বটেই।হাজার হলেও এটা তোমার মান ইজ্জতের ব্যাপার।” উমা হাতের কাজ গোছাতে গোছাতে বলে ” হুম। তাই এবার আমিও স্পেশ্যাল কিছু নিয়ম মানতে হবে বলে দিয়েছি।” “হ্যাঁ , তোমাকে বন্দনা করবার তো বিধি আছেই। এই যেমন পদ্মফুল ছাড়া চলবে না—” “নাগো, পূজো বিধিতে কিছু সংশোধনী এনেছি।এই যেমন ধরো পুরুতকে নামাবলী না পরলেও চলবে কিন্তু মাস্ক পড়তেই হবে।গঙ্গাজল না হলেও চলবে কিন্তু স্যানিটাইজার এবার চাই। কাটা ফল এবার নিষিদ্ধ।গোটা ফল দিতে হবে। এমনিতেও ছেলেমেয়েরা তো ঐ কাটাফলে ভ্যানভ্যান করা মাছি দেখে আনহাইজেনিক বলে নাক সিটকোয়। মহেশ্বর এমন নতুনত্ব বিধি শুনে ” কিন্তু ডারলিং নৈবদ্য কি করে হবে শুনি।” “হুম, সবকিছু মাথায় রেখে বলেছি একটা থালাতে নৈবদ্যর সামগ্রী প্যাকেটেই রেখে সাজিয়ে দিতে।আমি সময়মতো চাল ভিজিয়ে নৈবদ্য বানিয়ে নেব।”
“তা, বেশ।খুব ভালো বন্দোবস্ত।” “ভালো আর কোথায় হলো গো। এদিকের বর্ডারে চোদ্দদিন ওদিকে গিয়ে চোদ্দদিন কোয়ারেন্টিনে তো থাকতেই হবে ।তাই তো মহালয়ার পরে হাতে লম্বা সময় নিয়ে নিলাম।” “জয়তু ভব” বলে উইশ করলেন ভোলে মহেশ্বর। প্রত্যুত্তরে “থ্যাঙ্কুউউ ডিয়ার “বলে ছেলে মেয়েদের প্যাকিং এর দিকটা দেখতে ছোটেন দশভূজা দুর্গা। ওদিকে মর্ত্যে বড়বড় পূজো কমিটির পুরোহিতরা এবারে ছোট্ট করে পূজোর ফর্দ বানাতে ব্যাস্ত।
1)ধান –250 গ্রাম।
2)তিল —300 গ্রাম
3)হরতকী— 25 টা
4)স্যানিটাইজার– বড় 5 বোতল।
5) ভেনাস কোম্পানীর মাস্ক– 10টা।
“আমরা স্বজন “ক্লাবের সেক্রেটারী চক্কতীমশাইকে বলেন “10 টা মাস্ক কেন ?” বিগলিত হেসে চক্কতী মশাই বলেন “আসার সময় একটা ,যাবার সময় একটা।পাঁচদিনের।”
#সমাপ্ত।